করোনা নিয়ে একটি কল্প কাহিনী
মোবাইল স্ক্রীনে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে ডা: তৌফিক। ৬টা মিসকল। কল লিস্টের ডিটেইলে গিয়ে দেখতেই বুকের ধক ধকানি আরো বেরে যায়। সবগুলোই করেছেন জেলা সিভিল সার্জন। অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন না হলে কেউ এতবার কল করবে না।
বাড়ি যাবার আনন্দ আর প্রথম সন্তানের মুখ দেখবার ব্যকুলতায় ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মোবাইলের দিকে নজরই দিতে পারে নি। বের হওয়ার মুহুর্তে মোবাইল হাতে নিয়ে বাড়িতে ফেরার কথা জানাতে গিয়ে মিসকলগুলো নজরে আসে।একবার ভেবেছিল একেবারে বাড়ি গিয়েই কল করবে। কিন্ত দায়িত্বের কাছে আবেগের স্থান কোথায়?
আতংকিত মনে বাড়িতে কল করার পরিবর্তে সিভিল সার্জনকে কল করে তৌফিক।রিং হবার শব্দে মনের ভিতরের ভয়টা যেন আরও জাকিয়ে বসে।মনে মনে বলে, আর যাই হোক বাড়ি যাওয়াটা যেন আটকে না যায়।কল রিসিভ হয় না। আবার কি কল করবে না চলে যাবে বুঝতে পারছে না। দ্বীতিয়বার কল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কল রিসিভ হতেই ওপাশ হতে সিভিল সার্জনের উৎকন্ঠিত কন্ঠ কানে আসে। তৌফিক কোথায় থাক? কতবার কল করেছি জান তুমি!
সরি স্যার, আমি খেয়াল করি নাই। স্যার কোন জরুরী প্রয়োজন।
জরুরী না হলে কি এতবার ফোন দেয় কেউ!
শোন, তোমার ছুটি বাতিল করা হয়েছে, ইনফ্যাক্ট সবারই বাতিল করা হয়েছে।তুমি এখনই হাসপাতালে যাও পরিস্থিতির ভাল না। করোনার কি অবস্থা আমাকে জানাও।
কিন্ত স্যার আমার সন্তান...
হ্যা আমি জানি। কিন্ত বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার কিছু করার নেই।এখন তো ডাক্তার হিসাবে আমাদের দায়িত্ব একটু বেশি তাই না। শোন পরিস্থিতি ভাল হলে আমি তোমাকে ৫ দিন ছুটি দেব। এখন হাসপাতালে চলে যাও।
মনটা অত্যন্ত ভারী হয়ে গেল তৌফিকের। কি ভেবেছিল আর কি হলো। উপজেলার এ হাসপাতালটিতে 'উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার' পদটি ফাকা থাকায় তৌফিককেই দায়িত্বটি পালন করতে হচ্ছে। বাকি যারা আছেন তারা সবাই নতুন। এমন সময় তাকে যে ছাড়বে না সেটাই তো স্বাভাবিক।
বাড়িতে ফোন করে হাসপাতালের দিকে যাবার জন্য বের হলো তৌফিক।
গত কিছুদিন হতে অনেক রোগী আসছে। বেশিরভাগই সাধারণ সর্দি জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ।তাছাড়া হাসপাতালে করোনা সনাক্তকরণে এখনও কীট না আসায় আপাতত লক্ষণ বিবেচনা করে রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশন এ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের অদুরে একটি হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাইমারি স্কুলকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে।কেন্দ্রটিতে মাত্র একজন নার্স ও দুজন স্বেচ্ছাসেবি রয়েছে। ডাক্তাররাও কেউ সেখানে যেতে রাজি না হওয়ায় তৌফিক নিজেই প্রতিদিন একবার করে গিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছে।যদিও সে নিজেই অ্যাজমা জনিত শ্বাসকষ্টে ভুগছে তবু নিজের কথা ভুলে রোগীর সেবা দেয়াটাকেই বড় করে দেখে।
কোনদিক দিয়ে যে ৮ দিন কেটে যায় খেয়ালই করেনি।এমন পরিস্থিতিতেও সন্তানের মুখটা দেখার জন্য ব্যকুলতা এতটুকুও কমে না। প্রশাসন এর কঠোর পদক্ষেপ আর ব্যপক প্রচারনায় পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে। যদিও তার নিজের শরীরটাই এখন আর ভাল লাগছে না। গত কিছুদিন হতে কাশি আর হালকা জ্বর অনুভুত হচ্ছে।আজ পরিদর্শনে সিভিল সার্জন আসবার কথা আছে। এলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। সন্তানের মুখটা দেখবার কথা মনে হতেই শরীরের ক্লান্তি যেন কোথায় হারিয়ে গেল।যাবার সময় কি কি নিয়ে যাবে আর কি কিনবে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়ালই করে নি।
ড. তৌফিক, সিভিল সার্জনের গলা শুনে ধরফরিয়ে উঠে পড়ে।
আসসালামু আলাইকুম স্যার। শরীরটা ভাল না স্যার। একটু জ্বরও আছে। গত কয়েকদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।এটুকু বলতেও দুবার কাশে সে।
সিভিল সার্জনের অভিজ্ঞ চোখে রোগের লক্ষন ধরা পরে। তিনি দ্রুতই তৌফিককে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেন।ইতোমধ্যে জেলা শহরে রোগ সনাক্তকরণের কীট চলে আসাতে বিকালের মধ্যেই রিপোর্ট চলে আসে। পজিটিভ।একজন স্বেচ্ছাসেবি এসে রিপোর্ট টা জানিয়ে যায়।
ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তার মুখের দিকে চেয়ে ছিল তৌফিক।
অ্যাজমার রোগী হওয়ায় দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তৌফিকের। একজন ডাক্তার হিসাবে জানে সে রোগীর সেবা করতে গিয়ে নিজেই অনেক দেরি করে ফেলেছে। এখন আর তেমন কিছু করার নেই। তার সন্তানের মুখটাও আর দেখার কোন সুযোগ নেই।মরার আগে যদি একবারও দেখতে পেত তবু মরনকে হাসিমুখে বরণ করতে পারত।এখন তার খুব বাচতে ইচ্ছা করছে। তাকে বাচতেই হবে। ছোট্ট ছেলেটাকে নিজের বুকের উপর রেখে একবারের জন্য হলেও ঘুমোতে চায় সে।ছোট্ট ছেলেটা তার নরম তুলতুলে হাতে বাবার চোখে মুখে হাত বুলাবে।না তাকে বাচতেই হবে। সন্তানের বাবা ডাক না শুনে মরতে রাজি না। আল্লাহর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করে একবার শুধু ছেলেটাকে কোলে নিতে চায় সে।
স্যার , স্যার স্বেচ্ছাসেবি ছেলেটার ডাকে খুব কষ্টে চোখ মেলে তাকায়। শ্বাস কষ্টটা আরও বেড়ে গেছে।
আপনার স্ত্রী ফোন করেছিলেন। আমি ধরেছিলাম। উনি আপনার মোবাইলে আপনার ছেলের ছবি পাঠিয়েছে। দেখবেন না স্যার? মোবাইলের ছবিটা তৌফিকের সামনে ধরে ছেলেটা।
আহ কি সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটা। অপলক চেয়ে থাকে তৌফিক। নিশ্চল পলকহীন চোখে।
Comments
Post a Comment