গল্প হলেও সত্য

ক্ষেতের আইল ধরে একপ্রকার দৌড়াতে শুরু করে আক্কাস। মুখের দিকে একবার তাকিয়েই যে কেউ বলে দিতে পারবে মানুষটা কিছু একটা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। কম্পিত ঠোট আর অশ্রুসজল চোখে উদ্বেগের কারন ঠাওর করতে না পারলেও মাত্রাটা ঠিকই ধরা পরে।হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বটগাছের তলায় ছোট একটা দোকানের সামনে থামলো সে।
দোকানে তিন চারজন ছেলে আর একজন বৃদ্ধ বসে আড্ডা দিচ্ছে। একজন আবার মোবাইল হাতে একমনে কিছু একটা পড়ে চলেছে। আশপাশের রাস্তাঘাট একদমই জনমানব শুন্য।

রতন ভাই কালুরে দ্যাখছ? দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে আক্কাস।

কালুরে কি দরকার? তুমি এত হাপাইতেছ ক্যান। দোকানির কথা শুনে সবাই আক্কাসের দিকে তাকায়।

অর ভ্যানটা খুব দরকার।ছেলেডারে হাসপাতালে নিতে হইব।অরে আমি বাসায় একলা রাইখা আসছি।

আরে হইছেডা কী?

গত তিনচারদিন কাশতাছে। আজ আবার গায়েও জ্বর। গলায় কেমন ঘরঘর আওয়াজ আইতাছে। মা মরা ছেলেডা আমার বাড়িতে একলা আছে। অরে ছাড়া আমি বাচুম না। ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে আক্কাস।
শক খাওয়ার মত লাফিয়ে তিন চার হাত পিছিয়ে যায় মোবাইল হাতে ধরা ছেলেটি।ওরে তো করোনায় ধরছে ভয়ার্ত চোখে চিৎকার করে সে।হাতের মোবাইলটা সবার উদ্দেশ্যে দেখিয়ে বলে দ্যাখো এখানে কি লিখছে!কিছু একটা পড়ে শোনায় সে সকলকে। আক্কাসের বর্ননার সাথে অনেকটাই মিলে যায়।

এ রোগের কোন ওষুধ নাই। এর আশে পাশে যে যাবে তারেই ধরবে।আক্কাস ওর ছেলের সাথে ছিল এখন ওরেও ধরছে হরহরিয়ে কথাগুলো বলে সে।

ছেলাটার কথাতেই হোক বা ভয়েই হোক বিষম খাওয়ার মত হালকা কাশি দেয় আক্কাস।

ছেলেটার কন্ঠ এবার আরও উচ্চকিত হয়, দেখছেন আপনারা! বলেছিলাম না ওরেও ধরছে। সবাই সরে আসেন। সরে আসেন।

উপস্থিত সবাই দুরে সরে আসে।
সকলের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আক্কাস।মুখের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, করোনায় ধরুক আর ভুতে ধরুক ছেলেডারে তো হাসপাতালে নিতে হইবো।

বৃদ্ধ লোকটি ক্ষেপে যায়, শুনলা না এ রোগের কোন ওষুধ নাই।এইডা শুনছি আল্লাহর গজব, পাপের শাস্তি। যেহান দিয়া যাইবা সেহানেই এই রোগ হইব। আমরা তোমারে আর তোমার ছেলেরে বাড়ির বাইরে যাইতে দিমু না।

হাউমাউ করে কেঁদে বৃদ্ধের পা জড়িয়ে ধরতে যায় আক্কাস।
চকিতে লাফ মারে বৃদ্ধ।অন্যরা রীতিমত মারমুখি হয় এবার।বাড়ি যা। বাড়ি হতে আর বাইর হবি না, শাষায় বৃদ্ধ।

অস্রুসজল চোখে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করে আক্কাস।ছেলেটার কথা ভেবে গলা শুকিয়ে আসছে তার।
কথায় বলে 'খারাপ খবর বাতাসের আগে দৌড়ায়'। আক্কাস আর তার ছেলের খবর এরই মধ্যে গ্রামে ছড়িয়ে পরে।ফেরার পথে যারাই আক্কাসের পথে পরেছে দৌড়ে অন্যপথে গেছে অথবা আশেপাশের ঝোপে ঢুকে পরেছে সবাই। গ্রামের উৎসুক কিছু মানুষ আবার উকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে।নিজেকে জন্তুর মতো মনে হয়েছে আক্কাসের।মাইল দুরত্বের রাস্তাটা দশ মাইলের মতো দীর্ঘ মনে হয়েছে।

বাড়ি পৌঁছে ছেলের মাথার কাছে বসে ফুপিয়ে কাদতে থাকে। জীবনটাকে অনেক বেশি কঠিন আর নিষ্ঠুর মনে হয় তার কাছে।
ঘন্টা খানেকের মত হবে। বাড়ির উঠানে মানুষের আওয়াজ শুনে বের হয়ে আসে। বারান্দা হতে নামতে যাবে এমনি সময় গ্রামের মেম্বার তাকে ওখানেই থামতে বলে।সাথে স্থানীয় থানার কনস্টেবল।শাসনের সুরে কিছু নির্দেশনা অল্প কিছু খাবার, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ উঠোনে রেখে বাড়ির মাঝখানে একটি লাল পতাকা টানিয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই ছুটে এসে মেম্বারের পা জড়িয়ে ধরে আক্কাস। চিৎকার করে ছেলেকে হাসপাতালে নেবার অনুরোধ করতে থাকে।
কষে একটা লাথি মেরে পা ছাড়িয়ে নেয় মেম্বার। অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে সাবান আর পানি আনতে বলে একজনকে।
উঠানে পরে ছেলের জন্য কাদতে থাকে আক্কাস।
জন্মের সময় ছেলেটার মা মারা যাবার পর আর বিয়ে করে নি সে। নিজেই বড় করেছে ছেলেটাকে। আর আজ সেই ছেলে, চোখের সামনে মারা যাচ্ছে। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না সে। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।
সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সাথে সাথে অনেক কষ্ট ছেলেকে কোলে উঠিয়ে নেয়। বার তেরো বছরের একটা ছেলেকে কোলে নেবার মতো যথেষ্ট শক্ত সামর্থ নয় সে। তবু যাই হোক ছেলেকে হাসপাতালে নেবেই আজ।
বাড়ি হতে বের হয়ে বিশ গজ এগোতেই ৫/৬ জন যুবক তার পথ আটকায়। সকলের মুখ কালো কাপড় বা গামছা দিয়ে ঢাকা। যুবক ছেলে গুলোকে দেখেই ভয় পেয়ে যায় সে।ছেলে গুলো বাড়িতে ফিরে যাবার জন্য শাষায় তাকে। একজন তো আবার লাঠি দিয়ে বাড়ি বসিয়ে দেয়।

অনেক অনুরোধ করেও ছেলেগুলোর মন গলাতে পারে না। একজন একটু এগিয়ে আসে। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আক্কাসকে বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠায় আর কথা দেয় পরের দিন সে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ আর রোগের পরীক্ষা করাবে।
পরদিন সাংবাদিকটি একজন নার্স আর কিছু ওষুধ নিয়ে আক্কাসকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যায়।নার্সটি অত্যন্ত সতর্ক আর ভয়ে ভয়ে নমুনা সংগ্রহ করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
ঘটনার ৫ম দিন।
সাংবাদিক আক্কাসের বাড়িতে। হাতে একটি রিপোর্ট।
আক্কাস খুব অবাক হয়। এ কয়দিন যারাই এখানে এসেছে সবাই একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে কথা বলেছে। আজ সাংবাদিক তেমন কিছু করছে না। বরং খুব কাছে এসেছে। ছেলেকে দেখতে ঘরের ভিতরেও যেতে চাইছে। কালুকেও নাকি ভ্যান নিয়ে আসতে বলেছে। ছেলেটাকে হাসপাতালে নেবে।

আক্কাস কিছুই বুঝতে পারে না।অবাক হয়ে শুধু চেয়ে থাকে।

তোমার ছেলের করোনা নাই হাসিমুখে বলে সাংবাদিক।ওর নিউমোনিয়া হইছে।ঘরের ভিতরে গিয়ে তৎক্ষনাত বের হয়ে আসে। তোমার ছেলে কোথায় উৎকন্ঠিত হয়ে জানতে চায়।

হাতের ইশারায় বাড়ির পাশের একটা ঢিবি মত জায়গা দেখিয়ে দেয় আক্কাস।

কি বলবে বুঝতে পারে না সাংবাদিক।

দুদিন হলো আমার ছেলেটা মারা গেছে। কাউরে কিছু কইতেও পারি নি। লাশটারেও না জানি কি সব করে! লুকায়ে দুজনরে বলছিলাম। তারাও সাহস করেনাই কবর দিতে। অগো বুদ্ধিতে আমি নিজেই ঐখানে মাটিচাপা দিছি। মাছরে ডাঙায় তুললে শ্বাস নেবার জন্য যেমন মুখটা হা করে, আমার ছেলেডাও সেরম করাতাছিল। পারলে দুনিয়া সব বাতাস তারে আইনা দিতাম। বাপ হইয়াও আমি কিছু করতে পারি নি।চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পরছে তার।
ভাই আমার একটা কাজ কইরা দিতে পারবেন আকুতি ঝরে পরে আক্কাসের কন্ঠে।
সম্মতি জানায় সাংবাদিক।
উঠে গিয়ে চুলা হতে কাঠ কয়লা আর উঠানের মাঝে রাখা লাল পতাকাটা নামিয়ে সাংবাদিককে দেয়।এডাতে লিখে দেন, এহানে যে ঘুমাইতেছে সে কোন পাপ করে নি, তার করোনা আছিল না। এডা দিয়ে আমার ছেলের কবরটারে ঢাইকা দেব।
কম্পিত হস্তে লেখাগুলো লিখে আক্কাসকে দেয় সাংবাদিক।
আপনি এখন যান। আমি একটু কাদুম। ছেলেডা যেদিন মারা যায় ডরে সেদিন কানতেও পারি নি।
দ্রুত পা বাড়ায় সাংবাদিক। পেছন হতে ভেসে আসছে আক্কাসের চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ।

Comments

Popular posts from this blog

গড় বেতন ও অর্ধ গড় বেতন কাকে বলে এবং কীভাবে তা হিসাব করবেন।

নথিতে/অফিসিয়াল চিঠিতে ডিজিটাল স্মারক নং দেবার পদ্ধতি ও ব্যাখ্যা

জনস্বার্থে বদলীকৃত সরকারি কর্মচারিদের প্রকৃত যোগদানকাল নির্নয় করবেন যেভাবে